১৯৯২ সালে সংখ্যালঘু বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণার মূলনীতিসমূহ আলোচনা কর।

১৯৯২ সালে সংখ্যালঘু বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণার মূলনীতিসমূহ আলোচনা কর


ভূমিকা: বিশ্বের বহু দেশেই সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠদের দৃষ্টিতে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না। যদিও তারা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক, তথাপি বাস্তব জীবনে নানা অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত থাকে। ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তারা পিছিয়ে পড়ে। এই বৈষম্য নিরসনে জাতিসংঘ ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণ ও সুরক্ষার লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা গৃহীত করে, যা "Declaration on the Rights of Persons Belonging to National or Ethnic, Religious and Linguistic Minorities" নামে পরিচিত। এই ঘোষণায় মোট ৯টি মৌলিক নীতি (মূলনীতি) নির্ধারণ করা হয়েছে, যা নিচে গঠনতান্ত্রিকভাবে উপস্থাপন করা হলো

১৯৯২ সালে সংখ্যালঘু বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণার মূলনীতিসমূহ


১ম মূলনীতি (Article 1):

রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষায় দায়িত্বশীল থাকবে।

সংখ্যালঘুরা তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখা, তা প্রকাশ ও প্রচারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে।

এই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে।


২য় মূলনীতি (Article 2):

সংখ্যালঘুরা ব্যক্তি ও সম্মিলিতভাবে নিজ সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষা পালন এবং মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবে।

তারা দেশের অন্যান্য নাগরিকদের মতোই সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার পাবে।

সরকার সংখ্যালঘুদের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে সহযোগিতা ও সুযোগ প্রদান করবে।

সংখ্যালঘুরা নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংগঠন গঠন, তা পরিচালনা ও সংরক্ষণে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে।

নিজ গোষ্ঠী বা বিদেশস্থ গোষ্ঠীর সাথে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষার স্বাধীনতা থাকবে।


৩য় মূলনীতি (Article 3):

সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো বৈষম্য করা যাবে না; সবাই সমান অধিকারভুক্ত।

ঘোষণার মূলনীতিসমূহ পালন সংখ্যালঘুদের ঐচ্ছিক বিষয়—রাষ্ট্র জোর করে চাপিয়ে দিতে পারবে না।


৪র্থ মূলনীতি (Article 4):

সংখ্যালঘুদের ন্যূনতম মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে।

তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম ও ঐতিহ্য পালনে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগসহ ভাষা বিকাশে রাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।

সংখ্যালঘু সংস্কৃতিকে মূলধারার শিক্ষায় সংযুক্ত করতে হবে যাতে তারা সমাজে প্রান্তিক না হয়।

অর্থনীতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সংখ্যালঘুদের সঠিক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।


৫ম মূলনীতি (Article 5):

জাতীয় পর্যায়ের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রয়োজনে অন্য রাষ্ট্র বা সীমানাবহির্ভূত সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক গড়তে রাষ্ট্র বাধা দেবে না।


৬ষ্ঠ মূলনীতি (Article 6):

সংখ্যালঘুরা অন্যান্য গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ে স্বাধীন থাকবে।

রাষ্ট্রও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে।


৭ম মূলনীতি (Article 7):

সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে রাষ্ট্র প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।


৮ম মূলনীতি (Article 8):

জাতিসংঘ ঘোষণার মূলনীতিসমূহ কোনো আন্তর্জাতিক বাধা বা প্রতিবন্ধকতার অজুহাতে বাতিল করা যাবে না।

এই নীতিগুলোকে শুধু তাত্ত্বিক নয়, বাস্তব জীবনে কার্যকর করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।


৯ম মূলনীতি (Article 9):

জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এসব নীতিকে নিজেদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে।


উপসংহার: উল্লিখিত জাতিসংঘ ঘোষণার মূলনীতিগুলো আন্তর্জাতিক পরিসরে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তবে বাস্তবে এই নীতিগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাই মুখ্য চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্র যদি এদের শুধু নীতিগতভাবে স্বীকৃতি না দিয়ে কার্যকর রূপে অধিকার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়, তবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

No comments:

Post a Comment